শামসুল আলম স্বপন,কুষ্টিয়া :
একসময় আওয়ামীলীগে যোগদান করার জন্য মাহবুবউল আলম হানিফ পিছু পিছু ঘুরতেন কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক ও কুষ্টিয়া পৌরসভার তৎকালীন চেয়ারম্যান আনোয়ার আলীর । অর্থ সংকটে ছিলেন দিশেহারা ।
অর্থাভাবে দীর্ঘদিন যাবৎ ঢাকার নয়া পল্টনে অবস্থিত সিটি হার্টের অফিস ভাড়া পর্যন্ত দিতে পারতেন না। সেই হানিফ গত দেড় যুগে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদকে পুঁজি করেই সারাদেশে তার জাল বিস্তার করে তৈরি করেন অবৈধ ও বৈধ উপায়ে টাকা কামানোর নেটওয়ার্ক। দলীয় পদ ছাড়াও শেখ রেহেনা বিয়াইন এবং অঘোষিত ব্যবসায়িক পার্টনার হওয়ার সুবাদে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে তিনি বাগিয়ে নেন বিভিন্ন দপ্তরের টেন্ডার ও ব্যবসা-বাণিজ্যে। কুষ্টিয়ার বালিমহল,হাট-ঘাট, সাব-রেজিষ্ট্রার অফিসে চাঁদাবাজি, হাসপাতালে খাদ্য সাপ্লাই, মোটা অংকের টাকা নিয়ে চাকরি দেয়া থেকে শুরু করে হেন কাজ নেই যা তিনি নিয়ন্ত্রণ করতেন না । কুষ্টিয়ার এ সব কাজের দায়িত্বে ছিলেন ত্রাই চাচাতো ভাই আতাউর রহমান আতা । এমনও কথা শোনা যায় প্রতিদিন তাকে নগদ পাঁচ লক্ষ টাকা না দিলে হানিফ ক্ষেপে যেতেন আতার উপর।
আওয়ামী লীগের টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার সুযোগে মাহবুবউল আলম হানিফ হয়ে ওঠেন ক্ষমতাধরদের একজন। সেই সুবাদে গড়ে তোলেন সম্পদের পাহাড়। নিজ জেলা কুষ্টিয়া ছাড়াও রাজধানী ঢাকা ও ঢাকার বাইরে অন্তত ৪টি জেলায় তার সম্পদ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে আছে বলে অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে।
স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনের পর গত ২ অক্টোবর বুধবার সুপ্রিম কোটের আইনজীবী সালাউদ্দিন রিগ্যান -৩ (সদর) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মাহবুবউল আলম হানিফের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অর্থপাচারের অভিযোগ এনে তা অনুসন্ধানে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) আবেদন করেন । এর পেক্ষিতে হানিফের নামে থাকা সকল ব্যাংক একাউন্ট জব্দ করা হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন নাম না প্রকাশ করার স্বর্তে কুষ্টিয় দুদকের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ।
আইনজীবী সালাউদ্দিন রিগ্যান তার আবেদনে উল্লেখ করেন গত ২৬ সেপ্টেম্বর একটি জাতীয় দৈনিকে ‘কুষ্টিয়া থেকে কানাডা হানিফের সম্পদ সর্বত্র’ শিরোনাম খবর প্রকাশিত হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পরও অনুসন্ধানের জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষ কোনো উদ্যোগ গ্রহন করেনি। যে কারণে হানিফের বিরুদ্ধে তিনি দুদকে আবেদন করেন।
দেশে সম্পদের পাহাড় গড়ার পাশাপাশি কানাডাসহ কয়েকটি দেশে হানিফের সম্পদ ও ব্যবসা আছে বলেও জানাগেছে। হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর গা ঢাকা দিয়ে আছেন হানিফ। ভেঙ্গে পড়েছে তার সামরাজ্য । তার দোসররাও এখন পলাতক ।
মাহবুবউল আলম হানিফের বড় ভাই সাবেক সচিব রাশিদুল আলম শেখ পরিবারের জামাই। সেই সুত্র ধরেই হানিফ কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলায় আওয়ামী লীগের রাজনীতি করার সুযোগ পান। তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ছিলেন তিনি।
১৯৯৬ সালে আওয়ামীলীগ থেকে তিনি কুষ্টিয়া-২ আসনে মনোনয়ন পান । সাংগঠনিক দুর্বলতা ও অর্থ সংকটে তিনি পরাজিত হন। ২০০৮ সালে মহাজোট গঠনের পর হানিফ দল থেকে মনোনয়ন বঞ্চিত হন। আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় এলে হানিফকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী করা হয়।
এরপর শেখ রেহেনার বিশেষ সুপারিশে ২০১৩ সালের নির্বাচনে সদর আসন থেকে মনোনয়ন পেয়ে এমপি নির্বাচিত হন হানিফ। কাউন্সিলে পেয়ে যান যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের মত শীর্ষ পদ। এরপর হানিফকে আর পিছে ফিওে তাকাতে হয়নি। বাড়তে থাকে তার প্রভাব-প্রতিপত্তি। দলে তার অবস্থান আরো পাকা পোক্ত হয় একাধিকবার একই পদ পেয়ে যাওয়ার কারণে। মন্ত্রী হওয়ার খায়েস থাকলেও তার নানা অপকর্মের কারণে সে আশাপূরণ হয়নি ।
হানিফের কপাল খুলে যায় শেখ পরিবারের আত্মীয় হওয়ার সুবাধে। দলের শীর্ষ পদ পাওয়ার পরই তার কাছে লোকজনের আনাগোনা বাড়তে থাকে। দলের পদ-পদবি পাওয়ার জন্য অনেকেই ছুটে আসতেন তার কাছে। এছাড়া ঢাকা কেন্দ্রিক নানা কাজের তদবিরও করতেন হানিফ। দলের পদ-পদবি দেওয়ার নামে যেমন অর্থ বাণিজ্যে করেছেন তেমনি নানা তদবির, টেন্ডার বানিজ্যে, বড় বড় কাজ বাগিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছেন শত কোটি টাকা। হানিফের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম কোয়েষ্ট ইন্টারন্যাশনাল। কাওরান বাজারে বিএমটিসি ভবনে তার ব্যবসায়ীক ও রাজনৈতিক অফিস। সেই অফিস ও কুষ্টিয়ার বাসায় বসেই সব কিছু একহাতে নিয়ন্ত্রণ করতেন হানিফ। সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনে হানিফ তার হলফনামায় আয়ের উৎস হিসেবে ব্যবসা উল্লেখ করেন। সর্বশেষ স্ত্রীর নামে কুষ্টিয়ায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে লাইসেন্স নেন। লালন কলা বিশ্ববিদ্যালয় নামে কার্যক্রম শুরু করেছিলেন জেলা পরিষদের নতুন ভবনে।
তার নেশা ছিল রাজনীতির আড়ালে অর্থ আয় করা । ইউপি নির্বাচনে কুষ্টিয়া ৬ উপজেলায় চেয়ারম্যান প্রার্থীর কাছে দু.দবার নৌকা প্রতীক বিক্রি করে হাতিয়ে নিয়েছিলেন কয়েক কোটি টাকা। কুষ্টিয়া সদর উপজেলার আব্দালপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান প্রার্থী আরব আলী জানান যে টাকা দিয়ে নৌকা প্রতীক কিনেছিলাম সেই টাকা দিয়ে কমপক্ষে ২০টি বড় সাইজের কাঠের নৌকা কেনা যেত। তারপরও পাশ করতে পারেনি।
কুষ্টিয়া বাইপাস সড়ক, কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, জিকে প্রজেক্ট, হরিপুর সেতু, সড়ক ও জনপদ,গণপূর্ত, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরসহ বড় বড় প্রকল্প থেকে তিনি নিতে মোটা অংকের কমিশন ।
দলীয় ত্যাগী নেতা-কর্মিদের পাত্তা না দিলেও তিনি কুষ্টিয়াতেও চলতেন টাকা ওয়ালাদের সাথে। এভাবে গত ১৫ বছরে অঘাধ সম্পদের মালিক বনে যান হানিফ। হানিফের পুরো পরিবার থাকে কানাডায়। সেখানে তার কয়েকজন ভাই ও বোনেরাও বসবাস করেন। সেখানে হানিফের বাড়ি গাড়ি-সহ অঢেল সম্পদ আছে বলে জানা গেছে। খোঁজ জানা গেছে শহরের বহুতল বিপনী বিতান পরিমল টাওয়ারেও একাধিক দোকান আছে হানিফ ও আতার নামে। মার্কেট কমিটি জানায়, দুটি দোকানের দাম কোটি টাকার ওপরে। ভাড়া দেওয়া আছে দোকান দুটি। ভাড়া ওঠে প্রতি মাসে অর্ধলাখ টাকা। এছাড়া সমবায় মার্কেটের নিচ ও দোতলায় একাধিক দোকান আছে। সেখানে ব্যবসা আছে হানিফ ও আতার। যৌথভাবে এসব ব্যবসা করতেন দুই ভাই।
বিভিন্ন সুত্রে জানাযায়,কুষ্টিয়ার শীর্ষ ব্যবসায়ী অজয় সুরেকার সাথে হানিফের রয়েছে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা । অজয় সুরেকার কাছ থেকে তিনি নিতেন বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা । রাজনীকি না করলেও এসব কারণে অজয় সুরেকাকে হানিফ জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ পদ দেন ।
এসব বিষয়ে কথা বলতে অজয় সুরেকার সাথে তার মুঠোফোনে যোগাযোগ করে বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
শহরের হাউজিংয়ে ৫ কাঠার প্লটের ওপর ১০তলা বাড়ি নির্মাণ করা হয় কয়েক বছর আগে। প্রতি তলায় ৪টি করে ফ্লাট আছে। হাউজিং এলাকার বাসিন্দা সলেমান শেখ জানান হাউজিং এর জমির সাথে স্থানীয় একজনের জমি দখল করে এ বাড়ি নির্মাণ করা হয় কয়েক বছর আগে। আতার নামে হলেও পেছনে ছিলেন হানিফ। লোকজনের চোখ এড়াতেই হানিফ এ বাড়ি আতার নামে করেছেন বলে মনে করেন স্থানীয়রা। এসব ফ্লাট সজ্জিত করতে দেশের বাইরে থেকে টাইলসসহ ফিটিংসের মালামাল আনা হয়। পিটিআই রোডে ৪ কাঠা জমির ওপর তিনতলা বাড়ি নির্মাণ করেন হানিফ।
স্থানীয়রা জানান কাগজে কলমে আতা ও তার স্ত্রীর নামে হলেও হানিফের অর্থে এ বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে । প্রথম দিকে লালন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইনবোর্ড এ বাড়িতে লাগানো হয়। আতার সম্পদ নিয়ে দুদক অনুসন্ধান করার পর সাইনবোর্ড সরিয়ে ফেলা হয়। এছাড়া ঢাকা ও কুষ্টিয়ায় তাদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে, শেয়ার, ব্যাংকে ডিপোজিট আছে বলে জানাগেছে ।
কুষ্টিয়ার তমিজ উদ্দিন মার্কেট কমিটির সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক জানান, খেলার মাঠের পাশে দুই তলা নতুন যে মার্কেট হয়েছে সেখানে ৮টি দোকান আছে তাদের নামে। দোকানের ভাড়াটিয়ারা জানান, প্রতিমাসে হানিফের ভাই আতা টাকা তুলতেন।’
জেলা পরিষদের বটতৈল এলাকায় যে দোকান আছে সেখানে ১২টি দোকানের খোঁজ পাওয়া গেছে। প্রতিটি দোকান ভাড়া দেওয়া আছে। স্থানীয় ব্যবসায়ী নাজিম উদ্দিন বলেন, মার্কেট নির্মাণ করার পর এখানে হানিফ তার ভাইয়ের নামে ১২টি দোকান নেন। এসব দোকান থেকে মাসে লাখ টাকার বেশি ভাড়া ওঠে।
দলের একাধিক সুত্র জানিয়েছে, রাজনীতিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে গত ১৫ বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকা কামিয়েছেন হানিফ। এসব টাকার বড় অংশ পাচার করেছেন কানাডাসহ কয়েকটি দেশে। আর দেশে কয়েকটি বড় বড় কোম্পানীর সাথে বেনামে হানিফের ব্যবসা রয়েছে। এছাড়া গাজীপুরে পার্টনারে রিসোর্ট, কক্সবাজারে জমিসহ সম্পদের খবর পাওয়া গেছে। কুষ্টিয়া হানিফের ভাই আতার যে মার্কেট, দোকান ও শপিংমলে দোকান আছে সেগুলো দুইজনের অর্থে ক্রয় করা বলে জানা গেছে। এর মধ্যে জেলা পরিষদ অফিস সুত্র জানিয়েছে, তাদের নতুন দুটি দোকান নেওয়া আছে কোটি টাকায়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, হানিফ দলীয় ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে সারা দেশে নদী খননের বড় বড় কাজ বাগিয়ে নিয়েছেন । তার নিজের একাধিক ড্রেজার আছে খননের জন্য। সর্বশেষ গড়াই খননের একটি কাজ বাগিয়ে নেন তিনি। সরকারি খরচের তুলনায় কয়েকগুন বেশি খরচে তিনি কাজ করেন। এতে তার নিজের ৩টি ড্রেজার কাজে লাগান। প্রতি ডেজ্রারের ৩০ কোটি টাকার বেশি বলে সুত্র জানিয়েছে। বিভিন্ন ব্যাংকে নামে-বেনামে কোটি কোটি টাকা আছে হানিফের। সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনেও হানিফের নগদ টাকার পরিমান বহু গুন বেড়েছে বলে জানাগেছে । একাধিক সুত্র জানায় হানিফের পরিবারের সদস্যরা থাকেন কানাডায় । সেখানে হানিফের মেজ ভাই,এক বোন ও বোনের স্বামী থাকেন। সুত্র জানিয়েছে,হানিফ স্ত্রী ফৌজিয়া আলমের নামে কোন কিছু খরিদ না করলেও ভাই ও বোনের নামে সম্পদ করেছেন তিনি।
কুষ্টিয়ার মিরপুর ও ভেড়ামারায় পদ্মা নদী শাসনের জন্য ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প পাশ হয়। কাজ ভাগাভাগি হয় হানিফের ঢাকার অফিসে বসে। সেখানে হানিফ একাই ৫০০ কোটি টাকার কাজ নিজের কজ্বায় নিয়ে নেন। এসব কাজ পরবর্তিতে কমিশনে বিক্রি করে দেন। এ কাজ থেকে শতকোটি টাকা হাতিয়ে নেন হানিফ। হানিফের সময় কুষ্টিয়ায় বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্পের কাজ হয়েছে। এর মধ্যে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল প্রকল্প, কুষ্টিয়া শহর ফোর লেন সড়ক সম্প্রসারন করণ, কুষ্টিয়া বাইপাস সড়ক নির্মাণ, শেখ রাসেল কুষ্টিয়া-হরিপুর সেতু নির্মাণ প্রকল্প, মুজিবনগর সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্প। এছাড়া সম্প্রতি পদ্মা নদী শাসনে বড় একটি প্রকল্পের টেন্ডার হয়েছে। এসব প্রকল্পের প্রতিটি থেকেই হানিফ আগাম বাগিয়ে নেন কোটি কোটি টাকার কমিশন। প্রতিটি প্রকল্প থেকে শতকরা ১০ থেকে ১৫ভাগ কমিশন আদায় করতেন হানিফ। তার বাসায় বসে এসব ভাগাভাগি হতো। সেখানে সরকারি কর্মকর্তারা রাতে গিয়ে অর্থ দিয়ে আসতেন। এছাড়া নিয়োগ বাণিজ্যে,বালু ঘাটের কমিশনসহ অন্যান্য কাজ থেকে যে আয় হতো তা হানিফ চাচাতো ভাই আতাউর রহমান আতার মাধ্যমে সংগ্রহ করতেন। সেই টাকা আতা নিজে হানিফের কাছে পৌঁছে দিত বলে জানান দলের নেতারা। সর্বশেষ কুষ্টিয়া মেডিকেলে যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে হানিফের পছন্দের প্রতিষ্ঠান। এখান থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন হানিফ।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি সুত্র জানিয়েছে, দেশের বিতর্কিত একটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের মালিকের সাথে বেনামে যৌথ ব্যবসা আছে হানিফের। নদী খনন ও শাসনের কাজ করতেন তারা দুইজন। ওই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কাজের নামে কোটি কোটি টাকা অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ আছে। এ নিয়ে তার বিরুদ্ধে অভিযোগও আছে। তবে হানিফের কারণে পার পেয়ে যান সেই ঠিকাদার।
কুষ্টিয়ার সব ঠিকাদারী কাজ,হাট ঘাটের ইজারা,সরকারী বেসরকারী অফিস আদালতে নিয়োগ, পদ্মা ও গড়াই নদীর বালু মহাল থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্র থেকে কমিশন আদায় করেছেন হানিফ। এমন কি আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ-সহযোগি সংগঠনের পদ বিক্রির অভিযোগও রয়েছে হানিফের বিরুদ্ধে।
২০১৩ সালের নির্বাচেন আগে একটি সাধারণ মানের গাড়ী চড়লেও পরবর্তিতে তিনি একাধিক দামী গাড়ী ক্রয় করেন। যার প্রতিটির দাম কোটি টাকার ওপরে। ঢাকায় গুলশানে তার বাড়ি ও ফ্লাট আছে, আছে বনানীতে। এছাড়া খুলনায় তার মাছের ঘেরের সাথে আছে রিসোর্ট। জমি আছে পাবনার ঈশ্বরদী, কক্সবাজারের টেকনাফে। পার্টনারে গাজীপুরে নির্মাণ করেছেন একাধিক রির্সোট।
হানিফ কুষ্টিয়ার রাজনীতি ছাড়াও সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। এমনকি স্কুল কমিটির সভাপতি কে হবে সেটাও নির্ধারণ করে দিতেন হানিফ। তিনি এমপি হলেও মন্ত্রীর থেকে বেশি প্রটোকল পেতেন। কুষ্টিয়ায় আসলে সামনে ও পেছনে থাকতো পুলিশের ভ্যান। এছাড়াও স্পেশাল সিকিউরিটি পেতেন তিনি। হানিফ কুষ্টিয়ায় আসলে ঘিরে থাকতেন ব্যবসায়ীদের একটি দল। তাদের কারনে দলীয় নেতা-কর্মীরা কথা বলার মত সুযোগও পেতেন না।
দলের নেতাদের বাদ দিয়ে তিনি বিরোধী দলীয় ব্যবসায়ী ও নেতাদের সাথে বেশী আঁতাত করে চলতেন। তাদের মাধ্যমে সিন্ডিকেট করে সব প্রতিষ্ঠান থেকে লুটে নেন কোটি কোটি টাকা। বিশেষ করে খাজানগর এলাকার তিনজন চালকল মালিকের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এরমধ্যে দেশের বৃহত্তম চালের মোকাম কুষ্টিয়ার খাজানগরের রশিদ এগ্রো ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেডের মালিক আব্দুর রশিদ ওরফে চাল রশিদ ছিলেন অন্যতম। আব্দুর রশিদ ওরফে চাল রশিদ দেশের অন্যতম শীর্ষ চাল ব্যবসায়ী ও বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির সভাপতি। হানিফ তাকে দিয়ে চালের দাম বাড়িয়ে হাতিয়ে নিতেন কোটি কোটি টাকার কমিশন। চালের বাজারে সৃষ্টি হত অস্থিরতা। রশিদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে গেলেই বাধ সাধতেন হানিফ । একই সাথে কুষ্টিয়ায় খাদ্য সংগ্রহ থেকে কোটি কোটি টাকা লুটে নেওয়া হয়েছে বিগত ১৬ বছরে। এ টাকার বড় একটি অংশ দিয়ে কুষ্টিয়া শহরের এনএস রোডে আওয়ামী লীগের দলীয় অফিস নির্মাণ করেন হানিফ।
কুষ্টিয়া শহরের ফোর লেন সড়ক নির্মাণ কাজের একটি প্যাকেজ হানিফের পার্টনার স্প্রেকটা লিমিটেড নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এ লাইসেন্সে হানিফ নিজেই কাজ করেন। এছাড়া মুজিব নগর সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্পে গত ৪ বছরে শত শত কোটি কোটি টাকার ভাগ বাটোয়ারা হয়েছে। সব কাজ ভাভাভাগি করেছেন হানিফ ও তার ভাই আতাসহ আওয়ামী লীগের নেতারা। মুজিব নগর সমন্বিত প্রকল্পের প্রকৌশলীরা জানান, টেন্ডারে বেশির ভাগ কাজ নিতেন আতা। হানিফের নির্দেশে তাকে বড় বড় কাজ দিতে হয়েছে।
হানিফের অত্যাচার নির্যাতন থেকে আওয়ামী লীগের নেতারা যেমন বাদ যায়নি তেমনি বিএনপি-জামায়াত নেতা-কর্মিদের ওপর দমনপীড়ন চালিয়েছে তার ক্যাডার বাহিনী । জেলা যুবদল নেতা আল আমিন রানা বলেন,গত নির্বাচনের আগে একজন কাউন্সিলর আমার বাসায় গিয়ে জানাই হানিফের ভাই আতাউর রহমান আতা সাহেব চা খাওয়ার দাওয়াত দিয়েছে । আমি বলি এত বড় নেতার সাথে চা খাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এরপর থেকে তারা আমার বাড়ির ওপর মাস্তান পাঠিয়ে হেনস্থা করে, আমার নামে একের পর এক মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানী করেছে। এখন আমি ব্রেইন স্ট্রোক করে রোগী। মানসিক ও শারিরীক ভাবে তারা আমাকেসহ দলের বহু নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে গত ১৬ বছরে বিএনপিকে শেষ করে দিয়েছে।
এদিকে হানিফ আতার চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজির বিরোধীতা করার কারণে তাদের চরম রসানলে পড়েন কুষ্টিয়া জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারন সম্পাদক জনপ্রিয় তরুন নেতা সাজ্জাদ হোসেন সবুজ ( ৪০) । তাকে দল থেকে সরাতে না পেরে দুনিয়া থেকে সরানো পরিকল্পনা করেন হানিফ আতা দুই ভাই। ২০১৫ সালের ১৫ আগস্ট সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সাজ্জাদ হোসেন সবুজ স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে মজমপুর গেটস্থ বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালে শ্রদ্ধা জানাতে যান। ওই সময় হানিফ ও আতার দক্ষিণ হস্ত খ্যাত,কুষ্টিয়া শহর আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মোমিনুর রহমান মোমিজ হানিফের নির্দেশে সাজ্জাদ হোসেন সবুজকে হত্যা করার জন্য তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন। সাজ্জাদ হোসেন সবুজ প্রাণে বেঁচে গেলেও এলাপাতাড়ি গুলিতে কুষ্টিয়া পৌর এলাকার ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা সবুজ(২৩) নামে অপর এক যুবক নিহত হন।
ঘটনার দিন দুপুর ২টার দিকে মামলার ১ নম্বর আসামি জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের তৎকালীন সভাপতি আক্তারুজ্জামান লাবু, শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান আতার ছোট ভাই আতিকুর রহমান আতিক, শহর আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মোমিনুর রহমান মোমিজের ছোট ভাই হাফিজুর রহমান হাফিজ, জেলা স্বেচ্ছাসেবকলীগের তৎকালীন যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক হালিমুজ্জামান হালিম, কুঠিপাড়া এলাকার আবু তাহের, পেয়ারাতলা এলাকার রমজান হোসেন এবং খোকসা উপজেলার রবিউল হোসেন এবং অন্যান্যরা সাজ্জাদ হোসেন সবুজের বাড়িতে যান এবং হানিফের সাথে দেখা করার জন্য জবরদোস্তি করেন। এ সময় সবুজ তার স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস জিনিয়াকে সঙ্গে নিয়ে হানিফের বাড়িতে যান। হানিফ সবুজকে বলেন, যদি বাঁচতে চাও তাহলে আমার কথামতো চলতে হবে। আর র্যালিতে নিহত সবুজের পরিবার তোমার বিরুদ্ধে মামলা করবে। তুমি লাবুর (১ নম্বর আসামি) সঙ্গে গাজীপুরের ড্রিম স্কয়ার রিসোর্টে চলে যাও। আমি রিসোর্টের মালিককে বলে দিচ্ছি, সেখানে তুমি নিরাপদে থাকতে পারবে। হানিফের কথা মতো অন্যান্য আসামিদের মদদে রিসোর্টে ওঠেন সবুজ। সেখানে অবস্থানকালে সাজ্জাদ হোসেন সবুজ একদল সাদা পোষাকধারীদের হাতে গ্রেফতার হন। রাতের আঁধারেই সবুজকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে গুম করা হয়। আজ পর্যন্ত তার কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি।
গত ৫ আগষ্ট শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর হানিফ আতাসহ তার ক্যাডাররাও গা ঢাকা দেয় । এরপর গত ৯ সেপ্টেম্বর সোমবার ৯ বছর পর গুমের অভিযোগে সাজ্জাদ হোসেন সবুজের ভাই আরিফুল হোসেন সজিব মাহবুব উল আলম হানিফকে প্রধান আসামী করে ১১ জনের নামে কুষ্টিয়ার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হত্যা মামলা করেন। আদালত কুষ্টিয়া মডেল থানাকে মামলাটি গ্রহণ করে আসামিদের গ্রেপ্তারের নির্দেশনা দিয়েছেন ।
মামলার বিষয়ে সবুজের স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস জিনিয়া বলেন, আমার স্বামী অত্যন্ত জনপ্রিয় নেতা হয়ে উঠেছিলেন। কুষ্টিয়া পৌর মেয়র পদে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি। সেই লক্ষ্যে পৌরবাসীর সঙ্গে তিনি ভালো সখ্যতা গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু এমপি হানিফ, কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি হাজী রবিউল ইসলামসহ, আতা, সদর খান কেউই বিষয়টি মেনে নিতে পারেননি। আর সে কারণেই আমার স্বামীকে পরিকল্পিতভাবে অপহরণের পর গুম করা হয়। স্বামী ছাড়া সন্তানদের নিয়ে অত্যন্ত মানবেতর জীবনযাপন করছি। হানিফসহ অন্যান্য সব আসামিদের গ্রেপ্তার করা হলে অবশ্যই আমার স্বামীর হদিস পাওয়া যাবে।
৫ আগষ্ট গা ঢাকা দেয়ার পর হানিফ ও আতাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের নামে কুষ্টিয়াতে হত্যাসহ একাধিক মামলা হয়েছে। এরপর জেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার সাথে কথা হয় বর্তমান পরিস্থিতি ও হানিফের বিষয়ে। বেশিরভাগ নেতা বলছেন হানিফ রাজনীতি করার জন্য কুষ্টিয়ায় আসেনি। এসেছিল বাণিজ্যে করার জন্য। তার সময় দল ধ্বংস হয়েছে। হানিফ সিন্ডিকেট করে সব কাজ থেকে টাকা নিয়ে গেছেন। তিনি দেশের বাইরে টাকা পাচার করেছেন, গাড়ি ও বাড়ি করেছেন সেখানে। নেতা-কর্র্মিরাও তার হাত থেকে রেহায় পায়নি।’
অর্থবাণিজ্য ছাড়াও পরনারী আসক্ত নিয়ে কুষ্টিয়াতে হানিফের বিরুদ্ধে রয়েছে মুখরোচক গল্প । স্ত্রী কানাডায় থাকার সুবাদে হানিফ এক ডজনেরও বেশী নারীর সাথে সখ্যতা গড়ে তোলেন । এর মধ্যে কনা,মেহেরীন, স্বপ্না,মুক্তি জেবুন্নেছার সাথে ছিল অন্য রকম সম্পর্ক । হানিফ ঢাকা থেকে কুষ্টিয়ায় আসলেই ওই সব কথিত মহিলা লীগের পদধারী নারীরা সেজেগুজে ভীড় জমাতেন হানিফের বাসায় । কেউ কেউ ঢাকার বাসাতেও যেতেন । এ নিয়ে তার স্ত্রীর সাথে ছিল চরম মনোমালিন্য । দাম্পত্য কলহ ছিল প্রকট । এ সব নিয়ে জেলার নেতারা ছিল চরম বিব্রত।
হানিফ আতার অপকর্ম নিয়ে কোন সাংবাদিক সংবাদ প্রকাশ করলে হানিফ আতার পা চাটা সাংবাদিকরা হয় তার উপর হামলা হামলা চালাতো না হয় তাকে মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলে পাঠাতো । ভয়ে অনেকেই হানিফ -আতার বিরুদ্ধে নিউজ করতে সাহস পেত না । তবে প্রকৃত সাংবাদিকরা তাদের ঘৃণা করতো ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতা দৈনিক আমাদের সময়কে বলেন, হানিফ-আতা এই দুই ভাইয়ের কারণে কুষ্টিয়ায় আওয়ামীলীগের রাজনীতি ধ্বংস হয়ে গেছে। একক আধিপত্য বিস্তার করে আওয়ামী লীগের আদর্শ থেকে তারা বিচ্যুতি হয়েছিল। তাদের কারণে কুষ্টিয়াতে আওয়ামীলীগের মত এত বড় সংগঠনের আজ চরম দুর্দিনে।
এ বিষয়ে বক্তব্য নেয়ার জন্য হানিফের মোবাইলে ও আতার মোবাইলে কল করলে তাদের মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায় । সুত্র: দৈনিক আমাদের সময় : ৩০:১১:২৪