হানিফের চাচাতো ভাই আতার সম্পদের পাহাড়

নিউজ ডেস্ক | shadinbangla.news
আপডেট : ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪
Shadin Bangla
আতার সম্পদের পাহাড়


 

শামসুল আলম স্বপন,কুষ্টিয়া :  


কুষ্টিয়া-৩ আসনের সাবেক এমপি বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের যুগ্ম-সাধারন সম্পাদক মাহাবুবউল আলম হানিফের কুষ্টিয়া ভেড়ামারার ষোলদাগ গ্রামের বাড়ির কেয়ার টেকার আতাউর রহমান আতা নিজেকে হানিফের চাচাতো ভাই পরিচয়ে টেন্ডার বাজি,চাঁদাবাজি,মাদক ব্যবসা, বালুমহল দখল, চাকরি দেয়ার নামে ঘুষ আদায়সহ  নানা ভাবে অবৈধ আয়  করে গত ১৫ বছরে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়।   আতা ও তার স্ত্রী শাম্মী আরা পারভীনের নামে বিপুল পরিমান সম্পদ দেখে বিষ্ময় প্রকাশ করেছেন দুদক কর্মকর্তা ।
কুষ্টিয়া শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আতাউর রহমান আতা ও তার স্ত্রী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক শাম্মিয়ারা পারভীনের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয় বহির্ভুত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কুষ্টিয়া সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালতে মামলা দায়ের করেছেন । বিষয়টি নিশ্চিৎ করেছেন ওই আাদালতের দুদক পিপি ( পাবলিক প্রসিকিউটর ) ্এ্যাড. আল-মুজাহিদ হোসেন মিঠু ।
দুর্নীতি দমন কমিশন দুদক কুষ্টিয়া সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক নীল কমল পাল বাদী হয়ে গত ১১ মার্চ সোমবার এ মামলা দায়ের করেন। মামলায় আতার স্ত্রীর বিরুদ্ধে ৬৩ লাখ ৬৬ হাজার ৫৭৪ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছে। এছাড়া আতাউর রহমান আতা সদর উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে স্ত্রীর ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অবৈধ অর্থকে বৈধ করার ক্ষেত্রে সহায়তা করার কারণে এ মামলায় তাকেও আসামী করা হয়েছে।
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে আতাউর রহমান আতার স্ত্রী, কুষ্টিয়া ৪ নং পৌর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সাম্মিয়ারা পারভীনের জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ পেয়ে অনুসন্ধানে নামে দুদক। ২০২২ সালের ১২ জুন সাম্মিয়ারা পারভীনকে তার সম্পদ ও দায়-দেনার হিসাব বিবরণী দাখিল করতে বলে দুদক। সে অনুযায়ী ওই বছরের ৩ আগস্ট শাম্মিয়ারা দুদকে তার হিসাব বিবরণী দাখিল করেন। এতে ৩০ লাখ ১৩ হাজার টাকার স্থাবর সম্পদ ও ৪৮ লাখ ২০ হাজার ৯৮৮ টাকার অস্থাবর সম্পদ মিলিয়ে মোট ৭৮ লাখ ৩৩ হাজার ৯৮৮ টাকার সম্পদ দেখানো হয়।  পরে এসব তথ্য যাচাই-বাছাই শেষে দেখা যায়, প্রকৃতপক্ষে তার স্থাবর ও স্থাবর মিলিয়ে মোট সম্পদের পরিমান ৮১ লাখ ৯৯ হাজার ৪৫৬ টাকা। এ হিসেবে শাম্মিয়ারা ৩ লাখ ৬৫ হাজার ৪৬৮ টাকার সম্পদ গোপন করেছেন।
অন্যদিকে শাম্মিয়ারা পারভীনের সম্পদ বিররনী যাচাইয়ে ওই বিবরণী দাখিলের তারিখ পর্যন্ত সময়ে তিনি চাকরির বেতন ভাতা বাবদ ১৬ লাখ ৬১ হাজার ৮৯৪ টাকা এবং গৃহ সম্পত্তি ও দোকান ভাড়া বাবদ ৮ লাখ ৯ হাজার ৩০০ টাকা মিলিয়ে মোট ২৪ লাখ ৭১ হাজার ১৯৪ টাকা আয় করেছে বলে দুদক খোঁজ পায়। সম্পদ বিবরণী দাখিলের তারিখ পর্যন্ত সময়ে আয়কর রিটার্ন মোতাবেক তার পারিবারিক ব্যয় পাওয়া যায় ৬ লাখ ৩৮ হাজার ৩১২ টাকা। এতে আয়কর রিটার্নসহ তার মোট অর্জিত সম্পদের পরিমাণ দেখা যায় ৮৮ লাখ ৩৭ হাজার ৭৬৮ টাকা। সুতরাং ২৪ লাখ ৭১ হাজার ১৯৪ টাকা আয়ের বিপরীতে তার মোট অর্জিত সম্পদের পরিমাণ ৮৮ লাখ ৩৭ হাজার ৭৬৮ টাকা। সেক্ষেত্রে তার জ্ঞাত আয়ের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ সম্পদের পরিমান ৬৩ লাখ ৬৬ হাজার ৫৭৪ টাকা (যার মধ্যে গোপনকৃত সম্পদের মূল্য ৩ লাখ ৬৫ হাজার ৪৬৮ টাকা)। এটি দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪ এর ২৬(২) অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অন্যদিকে আতাউর রহমান আতা সদর উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে স্ত্রীর ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অবৈধ অর্থকে বৈধ করার ক্ষেত্রে সহায়তা করে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন বলে তার বিরুদ্ধেও অভিযোগ এনেছে দুদক।
দুদক আসামীদের বিরুদ্ধে দুদক আইন, ২০০৪ এর ২৬(২) ও ২৭(১) ধারা এবং দন্ডবিধির ১০৯ ধারায় মামলাটি দায়ের করেছেন । মামলা নং- ০২ /২০২৪ ্ তারিখ -১১/০৩/২৪ ইং।
আতাউর রহমান আতা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ও কুষ্টিয়া-৩ (সদর) আসনের সাংসদ মাহবুবউল আলম হানিফের কতিথ চাচাতো ভাই। তিনি হানিফের কুষ্টিয়ার বাস ভবনে বসবাসের পাশাপাশি তার (হানিফ) স্থানীয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন। এদিকে, স্ত্রীর পাশাপাশি আতাউর রহমান আতার নিজের জ্ঞাত আয় বহির্ভুত সম্পদের তদন্ত কাজও চালিয়ে যাচ্ছে দুদক। এ তদন্ত কাজও শেষ পর্যায়ে বলে জানিয়েছে দুদকদের স্থানীয় এক কর্মকর্তা।
মাহবুবউল আলম হানিফ ২০১৪ সালে প্রথমবারের সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার পর তার চাচাতো ভাই পরিচয়ে আতাউর রহমান আতার উত্থান হয়। বিগত ১৫ বছরে ভেড়ামারা উপজেলার বাসিন্দা আতা কুষ্টিয়া শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সদর উপজেলা চেয়ারম্যানের পদ বাগিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি অঢেল সম্পদের মালিক বনে গেছেন। গত বছর আতা ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জনের ব্যাপারে দুদকে অভিযোগ জমা পড়ে। পরে এসব অভিযোগের সত্যতা খুঁজতে মাঠে নামে দুদক। এদিকে এ দুর্নীতির অভিযোগ উঠার পর আতাউর রহমান আতার স্ত্রী সাম্মিয়ারা পারভীন সরকারী চাকরী থেকে ইস্তফা দেন। এ ব্যাপারে আতাউর রহমান আতার বক্তব্য জানতে ০১৭১৮১৬৩০৩৮  মোবাইল নম্বরে আতাকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেনি। দুুদক কুষ্টিয়া সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক নীল কমল পাল বলেন, বর্তমান সরকার দুর্নীতির ব্যাপারে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করছে। সরকারের এ নীতি বাস্তবায়নে দুদক কাজ করে যাচ্ছে।
আওয়ামী লীগের ১৫ বছরে আলাদীনের চেরাগ পেয়েছিল আতা। ঘসলেই যেন বেরুতে থাকে টাকা। এক কথায়, আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ বনে গেছে সে। ভাই হানিফ ও দলের প্রভাব খাটিয়ে ১৫ বছরে শুধু সম্পদই অর্জন করে গেছে আতা। কোন দিক না তাকিয়ে বাছ-বিচার ছাড়াই এক হাতে অর্থ কামিয়ে আওয়ামী লীগের অনেক শীর্ষ ও প্রভাবশালী নেতাদের সম্পদকে মানিয়েছে আতা। এমনকি হানিফের সম্পদ থেকেও আতার সম্পদ অনেক বেশি বলে মনে করেন দলীয় নেতারা।  
আতাউর রহমান আতা কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলার ষোলদাগ গ্রামের প্রয়াত আব্দুস সাত্তারের ছেলে। আব্দুস সাত্তার আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফের বাবা আফসার আলীর চাচাতো ভাই। সেই সূত্রে হানিফ আর আতা চাচাতো ভাই। হানিফের পর আতা ছিলেন কুষ্টিয়ায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে দ্বিতীয় ব্যক্তি। দুই ভাই মিলে জেলার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন। সব সরকারি কাজ ছিল তাদের নিয়ন্ত্রনে। এভাবে আতা জিরো থেকে বনে গেছেন শত কোটি টাকার মালিক। এ সময় একটি মটর সাইকেলে চড়লেও এখন তার কোটি টাকার দামি একাধিক গাড়ী আছে। স্ত্রী পাইমারী স্কুলের শিক্ষক হলেও স্বামীর টাকায় সেও কোটিপতি। ঢাকায় একাধিক ফ্লাট ও বাড়ি আছে আতার।
হানিফ দলের যুগ্ম সম্পাদক হওয়ায় আতা ছিল সবার কাছে আতঙ্কের। দলমত নির্বিশেষে সবাই আতাকে সামাল দিয়ে চলতেন। বিচার ও শালিস থেকে সব খানে আতার কথায় ছিল শেষ কথা। বিএনপির কয়েকজন নেতা ছিল আতার ঘনিষ্ঠ। তাদের মাধ্যমে ব্যবসা-বানিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন। এমনকি সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনের আগে হানিফের ভোটের কথা বলেও কোটি কোটি টাকা নেওয়া হয়। দলের নেতারা বলেন, কুরবানীর আগে গরু ও ছাগলও আসত উপহার হিসেবে। দেশ ছাড়াও দেশের বাইরে আতার সম্পদ ও অর্থ আছে বলে শোনা যায়।
আতার বাড়িতে থাকলেও সব সময় পাহারা থাকতো। বাইরে বেরুলে গাড়ী আগে-পিছে বহর নিয়ে বেড়াতেন। দলের পদ-পদবি ও টেন্ডারে কাজ পেতে আতার কাছে ধরনা দিতে হতো সবাইকে। তার অত্যাচার ও নির্যাতনে দল ছেড়েছেন অনেকে। এমনকি ঠিকাদারি কাজও ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন বেশ কয়েকজন। অবৈধ বালু ঘাট, হাট-বাজার, বিল ও বাউড় নিয়ন্ত্রণ করতেন আতা। তিনি এভাবে গত ১৬ বছরে শতশত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। হাসিনা পালিয়ে যাবার পর আতা গা ঢাকা দিয়েছেন। তার বাড়ি লুটপাট হয়ে গেছে। একই অবস্থা হানিফের বাড়িরও। আতার স্ত্রীর নামে অবৈধ সম্পদের অভিযোগে দুনীতি দমন কমিশন মামলা করেছে। আতার অবৈধ সম্পদ অর্জন নিয়ে অনুসন্ধান শেষ পর্যায়ে। যে কোন সময় মামলা হতে পারে বলে জানা গেছে।
জেলা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আতা ২০১২ সালের আগ পর্যন্ত ভেড়ামারায়ই ছিলেন। সেখানে ঠিকাদারীর পাশাপাশি সেচ্ছাসেবক লীগ ও যুবলীগের রাজনীতি করতেন।  
শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এবং সদর আসনের সংসদ সদস্য হানিফের চাচাতো ভাই ও স্থানীয় প্রতিনিধি- এসব পরিচয় আতার জন্য স্থানীয় রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারকে সহজ করে দেয়। দিন দিন বাড়তে থাকে তার প্রভাব, দলীয় নেতাকর্মীরাও আসতে থাকেন তার কাছে। অল্প দিনেই শহর ও সদরের রাজনীতিতে তৈরি করেন নিজস্ব বলয়। অভিযোগ আছে, পুরো জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতিই হানিফ নিয়ন্ত্রণ করতেন আতার মাধ্যমে।
এর পর অর্থ-বিত্তে-সম্পদে ফুলে ফেঁপে ওঠে আতাউর রহমান আতা। ২০২২ সালে আতার বিপুল অবৈধ সম্পদের ফিরিস্তি তুলে ধরে দুদকে একটি অভিযোগ জমা পড়ে। এতে বলা হয়, ১০ বছরের ব্যবধানে ভাই হানিফের প্রভাব আর আওয়ামী লীগের পদ-পদবি ব্যবহার করে বাড়ি-গাড়িসহ ১ হাজার ১০০ কোটি টাকার সম্পদের মালিক বনে গেছেন আতা। এই অভিযোগ উঠার পর ২০২২ সালে দুদক আতার অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করে।
আতা জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ কুষ্টিয়া অফিস থেকে সাড়ে ৫ কাঠার প¬ট নিয়েছেন। শহরের হাউজিং এলাকায় ওই জমিতে ৭ তলা ভবনের কাজ চলছে। স্কুল শিক্ষিকা স্ত্রীর নামে তিনি ওই সম্পদ করেছেন। এখানে বিনিয়োগের ব্যাপারে আয়কর নথিতে দেখানো হয়েছে মাত্র ৭৫ লাখ টাকা। অথচ ভবন করতেই খরচ হয়েছে ৫ থেকে ৬ কোটি টাকা বলে আতা ঘনিষ্ঠ এক আওয়ামী লীগ নেতা দাবি করেছেন।
এছাড়া কুষ্টিয়া হাই স্কুল মার্কেটে ১২টি,পরিমল টাওয়ারে দুটি ছাড়াও জেলা পরিষদ মার্কেট, সমবায় মার্কেটসহ বিভিন্ন মার্কেটে তার একাধিক দোকান আছে। শহরের বটতৈল এলাকায় জেলা পরিষদ মার্কেটের আটটি দোকান নিজ ও স্ত্রীর বরাদ্দ নিয়েছেন। একই মার্কেটে আরও চারটি দোকান আত্মীয়-স্বজনের নামে বরাদ্দ নিয়েছেন। ভেড়ামারায় ২৫ বিঘা জমি কিনে বাগান করেছেন। এছাড়া ২৪ শতাংশ জমি রয়েছে আতার।
তমিজ উদ্দিন মার্কেটের একাধিক ব্যবসায়ী বলেন,‘ কুষ্টিয়া হাইস্কুল কতৃপক্ষের কাঠ থেকে পানির দরে ১২টি দোকান নিজের নামে নিয়ে নেন আতা। এসব দোকান ভাড়া দেওয়া আছে।’
একই ভাবে বটতৈল জেলা পরিষদ মার্কেটে সব থেকে বেশি দোকান বাগিয়ে নেন আতা। সেখানেও তার নামে ৮টি দোকান আছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। একই ভাবে শহরের যেখানেই মার্কেট হয়েছে সেখানেই দোকান দিতে হয়েছে আতাকে। জেলা পরিষদ, পরিমল টাওয়ার, সমবায় মার্কেটেও একাধিক দোকান আছে আতার। এসব দোকান প্রভাব খাটিয়ে নিজের নামে নেন।
২০১৮ সালের ২৮ নভেম্বর নির্বাচন কমিশনে দাখিলকৃত হলফনামায় আতা ব্যবসা, অস্থাবর এবং স্থাবর সম্পদ মিলিয়ে তার মোট সম্পদ উল্লেখ করেন  ১ কোটি ৬৩ লাখ ৪৭ হাজার টাকা। বার্ষিক আয় দেখান ১ কোটি ১৫ লাখ ৫ হাজার টাকা। এরপর তিন মাস পর সদর ৫ম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী হন আতাউর রহমান আতা। সেই নির্বাচনে দাখিল করা হলফনামায় তার সম্পদের বেড়ে দাড়ায় ৩ কোটি ৫ লাখ টাকার ওপরে। অস্থাবর সম্পদ হিসাবে তিন মাস পূর্বে আতাউর রহমান আতা ও তার স্ত্রী শাম্মী আরা পারভীনের নগদ অর্থ না থাকলেও  ৫ম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের হলফনামায় তার নিজের নামে ৪ লাখ ৮৮ হাজার ৯৮৪ টাকা এবং স্ত্রী শাম্মী আরা পারভীনের নামে ১৫ লাখ টাকা নগদ দেখানো হয়।
অবিশ্বাস্য ভাবে সেই সম্পদ ৫ বছরে রকেট গতিতে বেড়েছে।  রাজ-বাদশাদের সম্পদ থেকে কোন অংশেই কম নয় আতার সম্পদের পরিমান। খালি হাতে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলা থেকে কুষ্টিয়া শহরে আসা আতাউর রহমান আতা যেন আলাদিনের চেরাগ হাতে পেয়েছেন। রুপকথার গল্পও হার মানাবে তার সম্পদ। শুধুূ ৫ বছরের ব্যবধানে নগদ ব্যাংক ও আর্র্থিক প্রতিষ্ঠানে নগদ টাকার পরিমান বেড়েছে ১৭৬গুনের বেশি। এর মধ্যে ব্যাংকে জমা আছে ৭ কোটি ২৬ লক্ষ টাকা আর এফডিআর আছে ১ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। তবে সর্বশেষ উপজেলা নির্বাচনে তিনি ব্যাংকে নগদ জমার পরিমান দেখান ৪ লাখ ৮৮ হাজার ৯৮৪ টাকা।  
৫ বছরেই শুধু নগট অর্থ বাড়েনি আতার বেড়েছে এপার্টমেন্ট, ফ্লাট ও দালান বাড়ি। একই সাথে বেড়েছে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে দোকান। কৃষি ও অকৃষি জমির পরিমানও হু-হু করে বেড়েছে। আগে লাখ টাকা দামের গাড়িতে চড়লেও এখন কোটি টাকা দামের গাড়িতে ঘোরেন।
৬ষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে নির্বাচনে আতাউর রহমান আতার দাখিলকৃত হলফনামা দেওয়া তথ্য অনুযায়ী স্থাবর এবং অস্থাবর সম্পদ মিলিয়ে তিনি সর্বমোট ১৯ কোটি ৯০ লাখ ৭৯ হাজার ৫৮৭ টাকা সমমূল্যের সম্পদের মালিক। পেশা হিসেবে দেখিয়েছেন ঠিকাদারি ব্যবসা। তবে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান থাকাকালে ঠিকাদারি কাজ কার নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে আতার বিরুদ্ধে নানা ভাবে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আছে। দুদকও বেশ কয়েকটি সরকারি সংস্থা তদন্ত করে এর সত্যতা পেয়েছে।  
৫ বছর সময়ের মধ্যে আতাউর রহমান আতা নিজের প্রভাব প্রতিপত্তিকে কাজে লাগিয়ে কুষ্টিয়ায় বহুতল বিশিষ্ট বাড়ী নির্মান সহ রাজধানী ঢাকায় কিনেছেন একাধিক ফ্লাট। হলফনামা অনুযায়ী হাউজিং এস্টটে ডি-৬ ও ডি-৭ প্লটে নির্মানাধীন বাড়ীর মূল্য দেখিয়েছেন ৪ কোটি ১৫ লাখ টাকা। এছাড়াও তার রয়েছে জারা টাওয়ারে পার্কিংসহ ৭৫ লাখ টাকা মূল্যের ফ্লাট, ঢাকার পাইকপাড়া আহাম্মদনগরে রয়েছে পার্কিংসহ ২৯ লাখ ৩৯ হাজার ২০০ টাকা মূল্যের একটি ফ্লাট এবং ঢাকার মিরপুরের ফেইথ গার্ডেনে ৩১ লাখ ৬০ হাজার ৮০০ টাকা মূল্যের আরো একটি ফ্লাট। শুধু তাই নয়
বাড়ী নির্মান এবং ফ্লাট ক্রয়ের পাশাপাশি তার কুষ্টিয়া সহ আশেপাশের শহরে একাধিক দোকানও রয়েছে। যার মধ্যে কুষ্টিয়া হাইস্কুল সুপার মার্কেটের ২য় তলার বি-ব্লকে ১০ লাখ টাকা মুল্যে ১হাজার বর্গফুটের ৬টি দোকান, পরিমল টাওয়ারের তৃতীয় তলায় ১৮ লাখ টাকা মূল্যের দোকান, ৮ লা টাকা মূল্যের কেন্দ্রীয় সমবায় মার্কেটের ২২ নং দোকান, ১৬ লাখ টাকা মুল্যের কুষ্টিয়া কুষ্টিয়া হাইস্কুল সুপার মার্কেটের ২ ও ৩ নং দোকান এবং বটতৈল এলাকায় ডাকবাংলো সুপর মার্কেটে ১৪ লাখ টাকা মূল্যের ৭টি দোকান। এছাড়া নামে-বেনামে আরো অঘাধ সম্পদ আছে আতার। সর্বশেষ অবৈধ সম্পদ অর্জনে তার ও তার স্ত্রীর নামে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। সেই মামলায় জামিনে আছে তারা। শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়েও দালিখ করা হলফনামায় দুই রকম তথ্য দিয়েছেন।
সংসদ নির্বাচনে দাখিল করা হলফনামায় উল্লেখ করেছিলেন এইচএসসি পাশ। তবে এবার উল্লেখ করেছেন এসএসসি পাশ। এদিকে ৫ম উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে তার দাখিলকৃত হলফনামা অনুযায়ী তার স্ত্রী শাম্মী আরা পারভীনের নামে ১৫ লাখ টাকা নগদ দেখানো হলেও এবারের দাখিলকৃত হলফনামা তার স্ত্রী নগদ কোন টাকা দেখানো হয়নি। এছাড়াও ডি-০৭ হাউজিং এস্টেটে ৬ লাখ ১২ হাজার টাকা মূল্যের ফ্লাট বা এপাটমেন্টের ৫০% এর মালিক হিসাবে তার স্ত্রী শাম্মী আরা পারভীনের নাম থাকলে এবারের হলফনামা থেকে তা বাদ দেওয়া হয়েছে।
দাখিলকৃত হলফনামা অনুযায়ী আতাউর রহমান আতা আয়ের উৎস হিসাবে কৃষি খাত থেকে আয় করেন ১৫ হাজার টাকা, বাড়ী/এপার্টমেন্ট/দোকান বা অনান্য ভাড়া থেকে আয় করেন ৫ লাখ ৮৫ হাজার ৪০০ টাকা, ব্যবসা থেকে আয় করেন ২ কোটি ৬৫ লাখ ১ হাজার ২০০ টাকা এবং শেয়ার/সঞ্চয়পত্র বা ব্যাংক আমানত থেকে আয় করেন ৩৭ লাখ ২৬ হাজার ৭৫৪ টাকা। তার অস্থাবর সম্পদের মধ্যে ৪ কোটি ৪০ লাখ ৯০ হাজার নগদ টাকা রয়েছে। এছাড়াও অস্থাবর সম্পদের মধ্যে আরো রয়েছে, ৯০ লাখ টাকা মূল্যের টয়োটা প্রডো (ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৭-৬৩৫৩) গাড়ী, ২ লাখ ৫ হাজার ৬৫৩ টাকা মুল্যের কুষ্টিয়া-হ-১৫-৮৬৬১ ও কুষ্টিয়া-হ-১৫-৮৬৬২ রেজিস্ট্রেশন নাম্বারের দুইটি মোটরসাইকেল, ৮ লাখ ৬০ হাজার টাকা মূল্যের ৩০ ভরি স্বর্ণালংকার। যদিও আগের হলফনামায় ২০ ভরি স্বর্ণালংকারের দাম ৮ লাখ ৬০ হাজার টাকা এবং ১০ ভরি স্বর্ণালংকারের দাম ৮০ হাজার টাকা। উল্লেখ্য একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দাখিলকৃত হলফনামায় তিনি ২৫ ভরি স্বর্ণালংকারের দাম ৮ লাখ ৬০ হাজার টাকা দেখিয়েছিলেন। হফলনামায় অস্থাবর সম্পদের তালিকায় তিনি ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা মূল্যের ইলেকট্রনিক সামগ্রী এবং ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা মূল্যের আসবাব পত্রও তালিকাভুক্ত করেছেন।
৬ষ্ট উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দাখিলকৃত হলফনামায় তিনি স্থাবর সম্পদ হিসাবে ১০ বিঘা কৃষি জমির মূল্য ১ লাখ ২০ হাজার টাকা, ২৩ দশমিক ৩৭ শতক কৃষি জমির মূল্য ৬ লাখ ৯৩ হাজার, ১৫ দশমিক ১৮ শতক কৃষি জমির মূল্য ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং ৭ দশমিক ৪৯ শতক কৃষি জমির মূল্য ২ লাখ ২২ হাজার টাকা উল্লেখ করেছেন। এছাড়াও স্থাবর সম্পদের মধ্যে তিনি দশমিক শুণ্য ৮২৫ একর অকৃষি জমির মূল্য ১৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা, ৬ কাঠা অকৃষি জমির মূল্য ৩৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা, দশমিক ৫৯৫০ একর অকৃষি জমির মূল্য ৬ লাখ ৪৮ হাজার ৫০০ টাকা, দশমিক শুণ্য ৬১৯ একর অকৃষি জমির মূল্য ১ লাখ ৮৭ হাজার টাকা, ৩ দশমিক ৫০ কাঠার প্লটের মূল্য ৫ লাখ ৭৮ হাজার টাকা এবং হাউজিং এস্টটে ডি-৬ ও ডি-৭ আবাসিক প্লটের মূল্য ১৬ লাখ ৬২ হাজার ৫০০ টাকা উল্লেখ করেছেন। এছাড়াও তার স্থাবর সম্পদের মধ্যে রয়েছে ১ লাখ টাকা মূল্যের ৩২ বোরের একটি পিস্তল ও ১ লাখ ১ হাজার টাকা মূল্যের একটি শর্টগান।
গত পাঁচ বছরে আতাউর রহমান আতার সম্পদ প্রায় ১৩ গুণের কাছাকাছি বাড়লেও সেই তুলনায় তার ঋণের পরিমান অতি নগন্য। নির্বাচন কমিশনে দাখিলকৃত পূর্বের দুই হলফনামায় তার কোন ঋণ না থাকলেও এবারের হলফনামায় পূর্বালী ব্যাংক কুষ্টিয়ার পিএলসি শাখা থেকে গাড়ী কেনা বাবদ ৩০ লাখ ১৬ হাজার ৯৮২ টাকা ঋণ নিয়েছেন বলে উল্লেখ করছেন।
উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ গ্রহণকারী প্রার্থীদের তালিকায় সবার উপরে থাকা আতাউর রহমান আতা’র বিরুদ্ধে তার স্ত্রী শাম্মী আরা পারভিনের (৪০) জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনে সহায়তার অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন সমন্বিত জেলা কার্যালয় কুষ্টিয়ার সহকারী পরিচালক নীল কমল পাল বাদী হয়ে অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকের ২০০৪ এর ২৬/(২) ও ২৭ (১) ধারাসহ দন্ডবিধির ১০৯ ধারায় তাঁদের বিরুদ্ধে কুষ্টিয়া জেলা ও দায়রা জজ (বিশেষ আদালত) মো. আশরাফুল ইসলামের আদালতে গত মাসের ১১ মার্চ (সোমবার) মামলা করেন। সেই মামলায় ৪ এপ্রিল বৃহস্পতিবার  দুপুর সাড়ে ১২টায় আইনজীবীর মাধ্যমে তারা সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালত এবং জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক রুহুল আমীনের আদালতে জামিন আবেদন করেন। বিচারক জামিন শুনানি শেষে ১০ হাজার টাকার বন্ডে এ মামলায় অভিযোগ দাখিল হওয়া পর্যন্ত তাদের জামিন মঞ্জুর করেন। গত ৫ আগষ্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনা পালানোর পর আতাও স্বপরিবারে গা ঢাকা দেন।

সুত্র: দৈনিক আমাদের সময় : ১২/১২/২৪