শামসুল আলম স্বপন,কুষ্টিয়া :
কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় অবস্থিত দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প গঙ্গা-কপোতাক্ষের (জিকে) বিকল হওয়া তিনটি পাম্পের মধ্যে ১টি পাম্প সচল হলেও পদ্মানদীতে পানি স্বল্পতার কারণে সেচ কার্যক্রম চালানো যাচ্ছে না। ফলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৪ জেলার প্রায় ১ লাখ ১০ হাজার ১০৭ হেক্টর জমি ফসল উৎপাদন থেকে হচ্ছে বঞ্চিত। এতে কয়েক হাজার টন খাদ্য ঘাটতির আশংকা দেখা দিয়েছে। পানির অভাবে ফসলের মাঠ ফেটে চৌচির। চাষীরা যেমন দিশেহারা তেমন এ এলাকার জীববৈচিত্র ধ্বংসের সম্মুখীন। জিকে খালে পানি না থাকা এবং বৃষ্টি না হওয়ায় কুষ্টিয়া,চুয়াডাঙ্গা, মাগুরা ও ঝিনাইদহ জেলার ২ লাখেরও অধিক টিউবওয়েল অকেজো হয়ে পড়েছে। সু-পেয় পানির অভাবে এ অঞ্চলের ৬০/৭০ লাখেরও অধিক মানুষ দুর্বিসহ জীবন যাপন করছে। গৃহস্থলী কাজ ও গোবাদি পশু পালনে হিমশিম খাচ্ছে তারা। এ অঞ্চলের অনেক কৃষক মাঠে গভীর নলকুপ বসিয়ে শ্যালো মেশিনের মাধ্যমে ধানের ফসলে সেচ দিলেও বৃষ্টি না হওয়ায় ধান চাষ হচ্ছে ব্যাহত । ধানের শীষ শুকিয়ে হয়ে যাচ্ছে চিটে ।
জি-কে সেচ প্রকল্পের আওতায় শুরুতে তিনটি প্রধান পাম্প ও ১২টি সাবসিডিয়ারী পাম্পের সাহায্যে খালে পানি দেওয়া হতো। এ বছর ১ ফেব্রুয়ারিতে ১ নম্বর পাম্প চালু করে পানি ছাড়া হয়। কিন্তু ১৯ ফেব্রুয়ারি থেকে সর্বশেষ সচল পাম্পটিও ইলেকট্রিক্যাল সার্কিট নষ্ট হওয়ায় বন্ধ হয়ে যায়। তাতে কুষ্টিয়া সদর ও মিরপুর এবং চুয়াডাঙ্গা সদর ও আলমডাঙ্গাসহ এই চার উপজেলার কৃষকেরা চরম দুর্ভোগে পড়েন। পানির অভাবে অনেক কৃষক ধান লাগাতে পারেনি । কারও কারও ধানের জমি শুকিয়ে চৌচির হয়ে গেছে। আবার কেউ কেউ শ্যালো ইঞ্জিন দিয়ে বিকল্প সেচের ব্যবস্থা করেছেন কিন্তু তাতেও আশানুরুপ সফলতা পাওয়া যাচ্ছে না । সেচ প্রকল্পের দুটি মেশিন আগে থেকে নষ্ট থাকায় চলতি বোরো মৌসুমে ১টি পাম্প দিয়ে প্রকল্পের আওতায় সর্বোচ্চ ৯৫ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়া সম্ভব ছিল। কিন্তু শেষ পাম্পটি নষ্ট হওয়ায় এবার সেই লক্ষ্যমাত্রাও পূরণ হয় নি। তবে গত এপ্রিল মাসে ১নং পাম্পটি জাপানের ইবারা করপোরেশনের প্রকৌশলীদের সহযোগিতায় কারিগরি ত্রুটি মুক্ত করে সচল করা হলেও পদ্মানদীতে পানি স্বল্পতার কারণে পাম্প চালু করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। সেচপ্রকল্পের একটি দায়িত্বশীল সুত্র জানায় পাম্প চালুর জন্য সেচ প্রকল্পের ইনটেক চ্যানেলে কমপক্ষে ১৪ ফুট উচ্চতায় পানি থাকা প্রয়োজন। কিন্তু পদ্মা নদীর পানি কমে যাওয়ায় ইনটেক চ্যানেলে পানির স্তর এখন মাত্র ১১ফুট ফলে পাম্প চালু করা সম্ভব হচ্ছে না।
অথচ ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর দিল্লিতে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে গঙ্গা নদীর পানি ভাগাভাগি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় । ভারতের প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবেগৗড়া ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই ঐতিহাসিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।
চুক্তির শর্তানুযায়ী প্রতিবছর মার্চ মাসের ১ তারিখ থেকে মে মাসের ১০ তারিখ পর্যন্ত পানি দেয়ার কথা কিন্তু সেই চুক্তি অনুযায়ী ভারত বাংলাদেশকে পানি না দেয়ায় সৃষ্টি হচ্ছে পানি সংকটের বলে মনে করেন পানি বিশেষরা ।
খোঁজ নিয়ে যানা গেছে ১৯৬২ সালে এই প্রকল্পের মাধ্যমে পদ্মা নদী থেকে ইনটেক চ্যানেলের মাধ্যমে পানি এনে পাম্প করে সরবরাহ খালের মাধ্যমে ৪ জেলার ১৩টি উপজেলায় ১ লাখ ১০ হাজার ১০৭ হেক্টর জমিতে পানি সরবরাহ করা শুরু হয়। শুরুতে বছরের ১০ মাস (১৫ জানুয়ারি থেকে ১৫ অক্টোবর) দিনরাত ২৪ ঘণ্টা ৩টি পাম্পের মাধ্যমে পানি তোলা হতো। বাকি দুই মাস চলত রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের কাজ। ১৯৩ কিলোমিটার প্রধান খাল, ৪৬৭ কিলোমিটার শাখা খাল ও ৯৯৫ কিলোমিটার প্রশাখা খালের মাধ্যমে সেচ প্রকল্পের পানি কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও মাগুরা জেলার কৃষকদের সেচ দেওয়ার এ কার্যক্রম শুরু হয়। শুরুতে কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা ও মাগুরা জেলার ১ লাখ ৯৭ হাজার হেক্টর জমিতে সেচের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। নব্বইয়ের দশকে ১ লাখ ৬ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়া সম্ভব হয়।
এখন দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প গঙ্গা-কপোতাক্ষের (জিকে) কার্যক্রম বন্ধ থাকায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কুষ্টিয়াসহ পার্শ্ববর্তী ৪ জেলার কয়েক লাখ চাষী। সেচ প্রকল্পের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পদ্মায় পানির স্তর স্বাভাবিক থাকলে প্রকল্পের একেকটি পাম্প প্রতি সেকেন্ডে গড়ে ২৮ হাজার ৩১৬ দশমিক ৮৫ লিটার পানি সরবরাহ করতে পারে।
কুষ্টিয়া অঞ্চলের কৃষকরা জানান, বিঘা প্রতি কৃষকেরা মাত্র ২০০ টাকার বিনিময়ে সেচ প্রকল্পের (জিকে) মাধ্যমে তারা পানি পেতেন। এবার সেচ প্রকল্পের (জিকে) মাধ্যমে পানি না পাওয়ায় বর্তমানে শ্যালো মেশিনের সাহায্যে সেচ বাবদ প্রতি বিঘায় খরচ পড়ছে ৬ হাজার থেকে ৭ হাজার টাকা। স্বল্প খরচের সেচব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন ৩৫ থেকে ৪০ গুণ বেশি খরচ করে শ্যালো মেশিনের সাহায্যে ধানের জমিতে সেচ দিচ্ছেন কৃষকরা। কতদিন পর থেকে আবার ধানের জমিতে সেচ প্রকল্পের পানি পাবেন তার কোনো সঠিক তথ্য দিতে পারছে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
সেচ প্রকল্প এলাকা ভেড়ামার কৃষক আবেদ আলী জানান, সেচ প্রকল্পের প্রধান এবং শাখা খালে পানি থাকলে সেচের পাশাপাশি আশপাশের নলকূপ ও পুকুরে পানি স্বাভাবিক থাকে। সেচ খালে পানি না থাকায় নলকূপে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি বলেন বোরো ধানে সবচেয়ে বেশি সেচ দিতে হয়। খেত প্রস্তুত থেকে শুরু করে দানা আসা পর্যন্ত সেচ লাগে। কখনো দিনে দুইবারও সেচ দিতে হয়। জানুয়ারি থেকেই ধান আবাদের জন্য পস্ত্রুতি নিচ্ছিলেন তাঁরা। কিন্তু পানি সরবরাহ শুরু ১৯ দিনের মাথায় হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দিশাহারা হয়েপড়েন কৃষকরা।
জি-কে কৃষক সমিতির সভাপতি আলাউদ্দিন বলেন, এ বছর আমরা এখনো পানি পাইনি। এই মৌসুমে পানি পাওয়া যাবে না এমন তথ্য পাওয়া গেছে । আমরা এখন স্যালো মেশিনের পানি দিয়ে ধান রোপণ করছি। এভাবে এক বিঘা জমি চাষ করতে অন্তত ৪০ থেকে ৫০ লিটার তেল (ডিজেল) লাগছে। এ ছাড়া ভাড়াসহ বিঘাতে কমপক্ষে ৬ হাজার থেকে ৭ হাজার টাকা বেশি ব্যয় হচ্ছে। এতে চলতি বোরো মৌসুমে ধানের উৎপাদন ব্যয় অনেক বাড়বে। বাড়তি খরচের আশঙ্কায় অনেক কৃষক ধান চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন ।
কুষ্টিয়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর উপপরিচালক সুফি মোহা: রফিকুজ্জামান দৈনিক আমাদের সময় কে জানান , সেচ প্রকল্পের পাম্প বন্ধ হওয়ার কারণে বোরো চাষে কৃষকদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। বিয়ষটি আমি কৃষি সম্প্রসারণের ঢাকা অফিসকে অবহিত করেছি। সম্প্রসারণ কর্মীদের মাধ্যমে কৃষকদেরও খবর দেওয়া হয়েছে। পানির কারণে এবার ফলন কম হবে। ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করে ধান রোপণে কৃষকদের অনেক ব্যয় বাড়বে। তিনি আরো বলেন এ বছর কুষ্টিয়া অঞ্চলে ৫৪৬ হেক্টর জমি পানির অভাবে চাষ হচ্ছে না । এতে কুষ্টিয়া অঞ্চলেই প্রায় ২৫শ মেট্রিক টন খাদ্য ঘাটতির আশংকা রয়েছে। ৪ জেলা মিলে ৬ থেকে ৭ হাজার টন খাদ্য ঘাটতি হতে পারে।
কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় গঙ্গা-কপোতাক্ষ (জিকে) প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান দৈনিক আমাদের সময় কে বলেন, দুটি পাম্প আগে থেকেই নষ্ট ছিল। তৃতীয় পাম্পটি দিয়ে ৩১ জানুয়ারি ক্যানেলে পানি সরবরাহ শুরু হয়। কিন্তু কারিগরি ত্রুটির কারণে ১৯ ফেব্রুয়ারি ওই পাম্পটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর জাপানের ইবারা করপোরেশনের সাথে যোগাযোগ করে ১নং পাম্পটি সচল করা হয়েছে কিন্ত ইনটেক চ্যানেলে স্বাভাবিক পানির স্তর না থাকায় সেচ কার্যক্রম চালু করা যাচ্ছে না। সেচের জন্য পদ্মায় পানি বৃদ্ধির অপেক্ষা করতে হচ্ছে । তিনি আরো জানান ২০০২ সাল থেকে সেচ পাম্পের ১২টি সাবসিডিয়ারি পাম্প অকেজো হয়ে আছে। আমরা চেষ্টা করছি ওই স্থানে নতুন পাম্প বসিয়ে এবং ২নং ও ৩নং পাম্পও সচল করে পানি সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার । এব্যাপারে পাম্প সরবরাহকারী কোম্পানী জাপানের ইবারা করপোশনের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে। তারা ১ নং পাম্পটি মেরামত করেছে এবং ৩ নং পাম্পটি মেরামত করার কাজ চলমান রয়েছে।
তিনি বলেন ২০০৬ সাল থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে পাম্প গুলো থেকে পানি সরবরাহ করা শুরু হয়। এর মধ্যে ২০১৭ সালে অগ্নিকান্ডে ৩ নং পাম্প ক্ষতি গ্রস্থ হয় এবং ২০২১ সালে ২নং পাম্পে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়। সেই থেকে পাম্প দুটি বন্ধ রয়েছে।
কুষ্টিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ড, কুষ্টিয়ার পওর বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রাশিদুর রহমান দৈনিক আমাদের সময় কে জানান, সেচ প্রকল্পে সার্বিক বিষয় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। চার জেলার ১৩টি উপজেলায় জিকের সেচ কার্যক্রম বিস্তৃত। প্রকল্পের প্রধান তিনটি খাল, ৪৯টি শাখা খাল ও ৪৪৪টি উপশাখা খাল রয়েছে। তিনি আরো বলেন, পানি সমস্যা সমাধানে সরকার অত্যন্ত আন্তরিক । এ সমস্যা হয়তো বেশী দিন থাকবে না।
কুষ্টিয়া-৩ আসনের সংসদ সদস্য কামারুল আরেফিন দৈনিক আমাদের সময় কে বলেন জিকে সেচ প্রকল্পের পানি সংকট নিয়ে আমি মহান জাতীয় সংসদে কথা বলেছি । পাশাপাশি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সাথেও আমার আলাপ হয়েছে। এ ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত আন্তরিক। সেচ প্রকল্পের জন্য ১২শ কোটি ও জিকে প্রকল্পের সার্বিক উন্নয়নের জন্য ১২শ কোটি মোট ২৪শ কোটি টাকার একটি প্রকল্প পরিকল্পনা মন্ত্রনালয়ে যাচাই বাছাই এর কাজ চলছে। খুব তাড়াতাড়ি এ প্রকল্প একনেকে পাশ হবে বলে আমি আশাবাদী। তিনি বলেন এ ছাড়া কুষ্টিয়া জেলায় সু-পেয় পানির জন্য জননেতা মাহবুব উল আলম হানিফ এমপির সহযোগিতায় ২৫০শ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে । এটিও দ্রুততম সময়ের মধ্যে পাশ হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন এ প্রকল্প গুলো বাস্তবায়ন হলে এ অঞ্চলে আর পানির সমস্যা থাকবে না।
সুত্র: দৈনিক আমাদের সময় : ৭/৫/২৪